স্বদেশ ডেস্ক:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অনেকটাই ‘অকার্যকর’ হয়ে পড়েছে। গঠনের পর জাতীয় ইস্যুতে ফ্রন্ট যতটুকু সরব ছিল, এখন ততটাই নীরব। নির্বাচন-উত্তর ড. কামাল হোসেনের নানা সিদ্ধান্তে তার দল গণফোরামে সমালোচনা হয়েছে। ফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপিও অন্তুষ্ট তার ওপর। যার কারণে শরিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে আর সামনে এগোতে চায় না বিএনপি।
জানা গেছে, গত দেড় মাসে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কিংবা সমন্বয় কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি। বিভাগীয় শহরগুলোতে গণশুনানি ও সমাবেশ করার ঘোষণা দিলও তা আর এগোয়নি। নুসরাত হত্যা নিয়ে রাজধানীর শাহবাগে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েও স্থগিত করা হয়। সম্প্রতি বেশিরভাগ সময়ই বিএনপির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করে বৈঠক ডেকেছেন ড. কামাল। এসব কারণে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধি দল যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ঐক্যফ্রন্টের পেছনে না ছুটে দল ও দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে সংগঠন
গোছানোকে যুক্তিযুক্ত মনে করছেন তারা। নির্বাচনের পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে স্কাইপে মতবিনিময় করেন। সেখানেও ঐক্যফ্রন্টের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তৃণমূল নেতারা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে সরে আসার মতও দেন অনেকে।
এর কারণ হিসাবে তারা বলেছেন, যে কোনো কর্মসূচিতে উপস্থিত সব নেতাকর্মী বিএনপির। অথচ খালেদা জিয়ার নামে সেøাগান দেওয়া যাবে না, ফ্রন্টের নেতারা তার মুক্তি চাইবে না- এমন জোট রাখা দরকার নেই।
সম্প্রতি বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম- জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানেও নেতাদের অধিকাংশের মত ছিল- ঐক্যফ্রন্টের প্রয়োজন নেই।
এ বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, ‘আমরা মনে করি এই ফ্রন্ট রেখে কোনো লাভ নেই। তারা থাকলে থাকবে, না থাকলে নেই। যেহেতু নির্বাচনের সময় জাতীয় প্রয়োজনে জোট গঠন করা হয়েছে, তাই চাইলেও ঘোষণা দিয়ে জোট ভেঙে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে আমরা ঘোষণা দিয়ে ভেঙেও দেব না। কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্ত হলে ফ্রন্টের নেতারা যদি তার নেতৃত্ব মেনে থাকতে চায়; থাকবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের আপত্তি থাকবে না।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, আমরা সবকিছুতেই আছি। বিগত দিনে ২০-দলীয় জোট অথবা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নানা কর্মসূচি করেছি। এখন দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। আবার সময় সুযোগ হলে পরিস্থিতি বুঝে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অথবা ২০-দলীয় জোটের ব্যানারে কর্মসূচি করব।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো কর্মসূচি নেই। তবে ভবিষ্যতে ফ্রন্টের কী অবস্থান হবে এবং কী কর্মসূচি হবে তা আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
বিএনপি নেতারা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ার পেছনে দলটির নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ্য ছিল- কারাবন্দি খালেদা জিয়ার অভাব পূরণ করতে দেশে-বিদেশে পরিচিত- এমন কোনো রাজনৈতিক নেতার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। তাই ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি।
যদিও কামাল হোসেনকে খালেদা জিয়ার আসনে বসানো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে করেন অনেক নেতাই। বিশেষ করে ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় তাকে নিয়ে বিএনপিতে ওই সময় থেকে সন্দেহ তৈরি হয়। স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, এখন মনে হয় ড. কামাল হোসেন বিএনপি নয়; সরকারেরই সুবিধা করে দিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দল। ড. কামাল এই ফ্রন্টের নেতৃত্বে আছেন অথচ বিএনপি নেত্রীসহ নেতাকর্মীদের মুক্তি চাইবেন না। এটি কী হতে পারে? ফ্রন্টের অবস্থাটা এমন যে, রাজ্য আছে, রাজা নেই। দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তি হওয়ার পর তিনিই ঠিক করবেন ফ্রন্টের ভবিষ্যতে কী হবে।
বর্তমান সময়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কার্যকর আছে কি নেইÑ সেই প্রশ্নে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, দেখুন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হয়েছে নির্বাচন সামনে রেখে। মূল লক্ষ্য রেখে সেই ফ্রন্ট হয়েছিল। সেই মূল লক্ষ্য তো আমাদের থাকবেই।
জানা যায়, গত দুই মাস ফ্রন্টের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ডেঙ্গু, ধর্ষণ, গণপিটুনিতে হত্যা, শেয়ারবাজারে ধসসহ নানা ইস্যু থাকলেও কর্মসূচি তো দূরে থাক ফ্রন্টের পক্ষ থেকে বিবৃতিও দেওয়া হয়নি। গত ১০ জুন সর্বশেষ ফ্রন্টের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ‘জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি’ বৈঠক বসেছিল উত্তরায় জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বাসায়। সেই বৈঠকে ড. কামাল হোসেনের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ‘অসুস্থতার’ কথা বলে তিনি যাননি। এ অবস্থায় গত ১০ জুলাই অসন্তুষ্ট হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে দেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তাকেও ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেই। বর্তমানে আ স ম আবদুর রব চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না লন্ডনে রয়েছেন। এ অবস্থায় বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করছে। ১৮ জুলাই বরিশালে ও ২০ জুলাই চট্টগ্রামে সমাবেশ করেছে। ২৫ জুলাই খুলনায় ও ২৯ জুলাই রাজশাহীতে সমাবেশ করবে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর বিভাগের জন্য আলাদা ৫টি ত্রাণ কমিটি করে গতকাল মঙ্গলবার থেকে কাজ শুরু করেছে। এসব কর্মসূচিতে ২০-দলীয় জোট অথবা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুছুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের সভা-সমাবেশে বক্তব্য মানে শুধু বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু। অথচ সরকারের বিরুদ্ধে, সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে সেভাবে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তিনি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা বলতে চান না। এটি হলে কেন আমরা তাকে (ড. কামাল হোসেন) নেতা বলব। আমার নেত্রী অসুস্থ হয়ে কারাগারে নির্যাতিত হচ্ছে, চিকিৎসা পাচ্ছেন না সেই মানবিকতাবোধও তার মধ্যে নেই। এর পরও কেন আমরা তথাকথিত ঐক্যফ্রন্ট ধরে রাখব?
ড. কামাল হোসেন ঘনিষ্ঠ গণফোরাম নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম দল বিএনপির কার্যক্রমেও ড. কামাল হোসেনও খুশি নন। তারেক রহমান ও জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে ড. কামালের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে জানান ওই নেতা।